মহোৎসবে অধরা ঘুষখোররা
প্রকাশিত : ০৭:৩৫ AM, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সোমবার ৩৩৫ বার পঠিত
গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতায় জিকে বিল্ডার্স করছে জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণ। এর পাইলিং থেকে শুরু করে বিল্ডিং নির্মাণ— সবকিছু। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এর কাজ ২০০৯ সালে শুরু হলেও হচ্ছে না শেষ। ১৪১ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৪৯৫ কোটি টাকা। এভাবেই জিকে অ্যান্ড বি কোম্পানির মালিক জিকে শামীম বাড়িয়েছেন ব্যয়।
এই বাড়তি ব্যয় থেকেই প্রধান প্রকৌশলীর মনও খুশি করেছেন। দিয়েছেন কোটি কোটি টাকা মাসোয়ারা। শুধু এই রাজস্ব ভবনই নয়, জিকে বিল্ডার্সের মালিক শামীমের হাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় প্রকল্প চলমান। সেগুলোও গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমেই করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার রাজধানীর নিকেতনে অফিস থেকে জিকে অ্যান্ড বি কোম্পানির মালিক জিকে শামীমকে র্যাব-১ গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলে এমনই উন্নয়ন কাজে ঘুষের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে রিমান্ডে জি কে শামীম এমনই অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের মন্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। আবার ফোন হলেও পরে বন্ধ করে দেন। তাই কোনো মতামত জানা সম্ভব হয়নি।
তবে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবেই জিকে বিল্ডার্সকে সিলেক্ট করে কাজ দেয়া হয়। তবে অভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে একচেটিয়া অনেকেই ঠিকাদারি করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে জানান তিনি। সার্বিক ব্যপারে জানতে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শম রোজাউল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন না ধরায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে সচিব মো. শহীদ উল্লাহ খন্দকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে ঘুষের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘কোনো মন্তব্য করা যাবে না’। আজ মন্ত্রী সার্বিক ব্যাপারে গণ মাধ্যমে কথা বলবেন।
সূত্র জানায়, অনেক আগে জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও গত অর্থবছরের ৪ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় এনবিআর ভবনের সংশোধিত ব্যয় অনুমোদন করা হয়। ব্যয় ১৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা থেকে হয়েছে ৪৯৫ কোটি টাকা। একাজ করছে জিকে বিল্ডার্সের কর্ণধার যুবদল থেকে খোলস পাল্টে যুবলীগ বনা শামীম।
সম্প্রতি রাজধানীতে (ক্যাসিনো) জুয়ার আসর বসায় বিভিন্ন ক্লাবে র্যাব অভিযানের পর শামীমের অফিসেও হানা দেয়। তার কাছে কোটি কোটি টাকা পাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গত শনিবার অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রাপাচারের দায়ে তিনটি মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে। মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শনিবার তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তাকে রিমান্ডে নিলে অকপটে স্বীকার করে সরকারি বড় বড় প্রকল্পের কাজে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতেন। কাজ পেতে তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে সমপ্রতি ঘুষ হিসেবে দিয়েছেন এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। প্রতি টেন্ডারে ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন দিতো। অনেক সময় নির্দিষ্ট কমিশনের পরও ঘুষ দিতে হতো। লাগামহীন ঘুষ-বাণিজ্যের কারণে কিছু প্রকল্পে তাকে লোকসানের মুখেও পড়তে হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, রিমান্ড জিজ্ঞাসাবাদে শামীম দাবি করেছেন প্রকৌশলী ছাড়াও যুবলীগের অন্তত দুজন শীর্ষ নেতাকে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা দিতেন তিনি। অবশ্য কাজ পেতে ওই নেতাদের নাম ভাঙাতে হতো তার। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি সাঁটিয়ে রাখে। তাদের নাম ভাঙিয়ে সরকারি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি।
২০০৮ সালে ক্ষমতার পালাবদলে যুবদল করা ও সাবেক গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ সহচর হচ্ছে ম্যানেজকারী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের জি কে শামীম। গণপূর্ত অধিদপ্তরে আধিপত্য বিস্তারে তার বেশি সময় লাগেনি। শুধু তাই নয়, শামীম তার দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরতো। তাই গণপূর্তের সাবেক প্রকৌশলীদের মোটা অঙ্কের কমিশন দিলেও ঠিকাদারদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতেন শামীম।
বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতায় প্রায় সোয়া দুইশ প্রকল্প চলমান। এরমধ্যে প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত শামীমের প্রতিষ্ঠান সরকারের অন্তত ২২টি বড় প্রকল্পের কাজ করছে। ঠিকাদারি জগতে তিনি ছিলেন অঘোষিত ‘টেন্ডার কিং’। অল্প সময়ে তার বিপুল অর্থের মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উত্তরায় র্যাব সদর দপ্তর, পোড়াবাড়ীতে র্যাব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবন, এনজিও ভবন, নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিজ্ঞান জাদুঘর, সচিবালয়ের সমপ্রসারিত ভবন, বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির, হিলট্র্যাক্টস ভবন ও মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শামীমের প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ল্যাবরেটরি মেডিসিন ভবন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও কেবিনেট ভবন নির্মাণসহ বেশকিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ পেতে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়েছেন শামীম। রূপপুরের কাজেও কমিশন দিয়েছেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদে শামীম স্বীকার করেন, বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে তার তিন হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অধীনে আবাসিক ভবন নির্মাণে অনিয়মের ঘটনায় শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত হয়।
শামীম আরও জানান, ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ নেতাকে ‘সন্তুষ্ট’ রাখতে নিয়মিতই মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। এর বাইরেও তার অর্থভোগীর তালিকা অনেক দীর্ঘ।
এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণ কাজ পাওয়ার ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আমার সংবাদকে বলেন, জি কে শামীম আমার আমলেই কাজ পায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে। নিয়মের জটিলতায় হয়তো সে বড় বড় কাজ পেয়ে যায়।
এর ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, পিপিআরের শর্ত হিসেবে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। এ জন্য খারাপ রেকর্ড থাকলেও তারা বাদ যায় না। কাজের ব্যাপারে ঘুষ— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কারও অভিযোগকে ভিত্তি করে কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়। এর জন্য সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করা উচিৎ। তাহলে সঠিক তথ্য বের হবে।
তিনি আরও বলেন, আগে অনেক কম প্রকল্প ছিলো। বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে। তাই মোটা অংকের প্রকল্প চলমান। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এই প্রকৌশলী বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। আবার অনেকটা পিডব্লিউডির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। কাজেই এখানে ঠিকাদাররা কাজ জিইয়ে রাখে তা বলা যাবে না। তারা শর্ত অনুযায়ী কাজ করে। তবে অনেক সময় তারা খামখেয়ালি কিছু করে থাকে বলে এই অভিজ্ঞ প্রকৌশলী স্বীকার করেন।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাজধানীর নিকেতন এলাকার অফিস থেকে জিকে অ্যান্ড বি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। এ সময় বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসাবে রাখা ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার কাগজপত্র, নগদ এক কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ৯ হাজার মার্কিন ডলার ও ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও জব্দ করা হয় আটটি বৈধ অস্ত্র ও ২৩টি ব্যাংকের ৮৩টি চেক। নামে-বেনামে যেসব ব্যাংকে শামীমের অর্থ রয়েছে সে ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে আটটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে তার এফডিআর পাওয়া গেছে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি Alokito Sakal'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyalokitosakal@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
Alokito Sakal'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।