পদ্মাপাড়ের হাজার মানুষ গৃহহীন
প্রকাশিত : ০৭:৫৯ AM, ৭ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার ২১১ বার পঠিত
শরীরে দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল তিনি অন্তঃসত্তা। নাম জিজ্ঞাসা করতেই রাজ্যের লজ্জাভরা কণ্ঠে বললেন- রওশনারা। চোখেমুখে তার রাজ্যের হতাশা। অন্যদের সঙ্গে তারও আশ্রয় হয়েছে দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠের এক পাশে। বসতঘরের টিনের দু’খানা চাল আড়াআড়ি করে তাঁবুর মতো জায়গাটায় তার আপাতত আবাস। এর সঙ্গে কাঠের একখানা চৌকি, সঙ্গে ঘর-গৃহস্থের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
বেলা প্রায় ৩টা। সকালে সামান্য কিছু খেলেও দুপুরের খাওয়া হয়নি তখনও। চার-পাঁচ দিন আগে ১নং ফেরিঘাট এলাকা থেকে ভাঙনে ভিটে-মাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয়েছে তাদের। রওশনারা জানান, তার স্বামী দিনমজুর মমিন মণ্ডল গেছেন ভাঙন থেকে তার বোনের বাড়িঘর উদ্ধার করতে। তার শ্বশুর-শাশুড়ি আশ্রয় নিয়েছেন এক চাচাশ্বশুরের বাড়িতে। এখানে খুবই অসহায় অবস্থায় আছেন তিনি। শরীরের এই অবস্থায় কখন কী হয়ে যায়, সে চিন্তাই শুধু তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।
ভাঙনে সাজানো সংসার ও সহায়-সম্বল হারানোর কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন রওশনারা। রোববার দুপুরে সরেজমিন গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের আরপিডিএস মাঠে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শতাধিক পরিবার তাদের বসতঘর সরিয়ে এনে স্তূপ করে রেখেছে। ঘরের চালা ও আসবাবপত্রের ফাঁকফোকরে তাদের চরম মানবেতর দিন-রাত। সবার চোখেমুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা। কোথায় যাবে, কীভাবে কাটবে তাদের আগামী দিন, তারা কেউ জানেন না তা।
চোখে পড়ল স্তূপ করে রাখা একটি ঘরের পাশে বসে ঘাসযুক্ত মাটি তুলে একটি পাত্রে রাখছেন বৃদ্ধ দম্পতি। নাম জিজ্ঞেস করলে জানান, আব্দুল কুদ্দুস খাঁ (৭০) ও হাসনা বেগম (৬৫)।
‘কী করছেন?’
রাজ্যের হতাশা তাদের কণ্ঠে, ‘পাশের গ্রাম থেকে কিছু ধান চেয়ে এনেছিলাম, সে ধান ঘাসের মধ্যে পড়ে গেছে। তুলে পানিতে ধুয়ে আলাদা করব।’
‘কবে এখানে এসেছেন?’
যথাযথ উত্তর দেওয়ার আগে শুরু করলেন তাদের দুঃখগাথা- দেবগ্রাম ইউনিয়রেন আজিজ সরদারের পাড়ায় তাদের বাড়ি ছিল। নদীভাঙনের শিকার হয়ে এক সপ্তাহ আগে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃদ্ধ আব্দুল কুদ্দুস দৌলতদিয়া ঘাটে কুলির কাজ করতেন। ওই সময় একটি হাত ভেঙে যাওয়ায় আর কাজ করতে পারেন না। এক ছেলে সেলুনে কাজ করে, আরেকজন রিকশা চালায়। তাদের আয়ে সংসার চলে না। রিকশাচালক ছেলে রফিক খাঁর রিকশাটিও বিকল হয়ে থাকায় রোজগার নেই বললেই চলে। এর মধ্যে রফিকের ঘরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১৯ দিন বয়সী সেই সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এখানে।
‘শিশু নাতিটি কেমন আছে?’
বৃদ্ধা হাসনা বেগম বলেন, ‘কেমন আর থাকব বাবা, নিজেরা খাওন পাই না, ছেলের বৌকে কী খাওয়াব? আর নাতির মা যুদি খাওন না পায়, কোলের পোলার খাওনের দুধ আসপো কোহানথনে। এক ফোঁটা বুহির দুধির জন্নি নাতিটা খালি চিল্লায়।’
এ রকম শত শত গল্প এখন পদ্মাপাড়ের ঘরে ঘরে। এখানে আশ্রয় নেওয়া হাবিব খাঁ, নাজিমদ্দিনসহ অনেকেই জানান, এই খোলা মাঠে তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখানে নেই কোনো টিউবওয়েল ও পায়খানা। তাদের কয়েকশ’ অসহায় মানুষের কথা চিন্তা করে যদি এখানে কয়েকটি টিউবওয়েল ও পায়খানা স্থাপন করা হয়, তবে কিছুটা স্বস্তি পেতেন তারা।
গত কয়েক দিনে পদ্মার ভাঙনে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীতে বিলীন হয়েছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। গত এক সপ্তাহে শত শত পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন স্থানে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ পরিবার বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক, স্কুলের মাঠে, খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সামান্য আয়ের দিনমজুর মানুষরা তাদের পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ গরু-ছাগল নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে।
দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠে ৫০-৬০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে ছোট্ট তাঁবুর মাঝে তিনটি ছেলে, একটি মেয়ে ও তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে গত কয়েকদিন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন মাজেদা বেগম। খাবার পানি, গোসল ও প্রস্রাব-পায়খানার কোনো ব্যবস্থা নেই। মাজেদা বেগম জানান, সকালে কোনো রকম রান্না করতে পারলেও রাতে রান্নার মতো চাল বা অন্য কিছু তার কাছে নেই।
খোলা আকাশে নিচে আশ্রয় নেওয়া একাধিক অসহায় মানুষ চোখেমুখে হতাশার ছাপ নিয়ে জানায়, প্রায় ১৫০টি পরিবার বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। তাদের ঘর তোলার মতো কোনো জায়গা-জমি নেই। তারা সবাই দিন এনে দিন খান। ফের ঘর তুলে মাথাগোঁজার মতো ব্যবস্থা নেই কোনো। দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ঢল্লাপাড়া গ্রামের রেজাউল করিম জানান, এক সময় তাদের প্রায় শতাধিক বিঘা জমি ছিল। কয়েক বছরের ভাঙনের পর অবশিষ্ট ছিল প্রায় ২০ বিঘা জমি। এবারের ভাঙনে তাও বিলীন হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ ধরে অন্যের জমিতে ঘরগুলো ভেঙে এনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ঘর তোলার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছেন না।
এদিকে দৌলতদিয়া ১নং ও ২নং ফেরি এলাকার শত শত বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চোখের জল আর গায়ের ঘাম যেন এক হয়ে গেছে। কারও কোনো কথা বলার সময় নেই। সবারই একটাই চাওয়া- নদীতে সর্বস্ব বিলীন হওয়ার আগে যতটুকু সরানো যায়। এ সময় অসহায় মানুষের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় সেখানে।
১নং ফেরিঘাটের মাথায় ভাঙনের একেবারে মুখে থাকা দুই ভাই আরশাদ সিকদার ও খবির সিকদার তাদের বিরাট দুটি টিনের ঘর ভাঙছিলেন। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন আত্মীয়-স্বজনরা। কথা বলার সময় শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন আরশাদ সিকদার।
সরকারি হিসাবে গত শনিবার পর্যন্ত দেথৗলতথদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ও ফেথরিঘাটসহ আশপাশ এলাকার ৫৫৮টি পরিবার ভাঙথনের শিকার হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে অন্যত্র সরে গেছে আরও কয়েকশ’ পরিবার। এখনও নিরাপদ স্থাথনে যাওয়ার চেষ্টা করথছেন অনেকে।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি অফিসার শিকদার মুহা. মুহায়মেন আক্তার জানান, গত এক সপ্তাহের নদীভাঙনে ১৮০ হেক্টর জমির ফসল নদীতে চলে গেছে। এ ছাড়া আকস্মিক বন্যায় ২৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, আমরা শনিবার পর্যন্ত ৫৫৮টি পরিবারের নদীভাঙনে সর্বস্ব হারানোর তথ্য পেয়েছি। তাদের জন্য নগদ অর্থ, ঢেউটিন ও খাদ্য সাহায্য চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছে জেলা প্রশাসনে। এর আগে তালিকা করা ৫৯টি পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দুর্গতদের দৌলতদিয়া আক্কাস আলী হাইস্কুল, দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন হেলিপ্যাডের উঁচু স্থান, দেবগ্রাম আশ্রয় কেন্দ্র, গুচ্ছগ্রামসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন হয়ে পড়া এসব পরিবারের মধ্যে সরকারি খাস জমি চিহ্নিহ্নত করে বন্দোবস্ত দেওয়ারও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি Alokito Sakal'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyalokitosakal@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
Alokito Sakal'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।