পথবাসীদের পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে
প্রকাশিত : ০৬:১৪ AM, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার ২৯০ বার পঠিত
‘আমরা এই পার্কেই থাকি। মাঝে মধ্যে তাড়িয়ে দিলে অন্য কোথাও গিয়ে থাকি। রাস্তায় কোনো খাবার পড়ে থাকলে বা মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খাই। মা ভিক্ষা করেন। মাঝে মধ্যে তার সাথে দেখা হয়।’ এভাবেই মনের কষ্টের কথা বলছিল সোহেল নামের এক পথশিশু। সে গুলিস্তান পার্কেই রাতে থাকে। গত কিছুদিন যাবত এখানেও থাকতে দেয়া হয় না। মাঝে মধ্যে অন্য কোথাও গিয়ে থাকে। সরকারি বা বেসরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না বলেও সে জানিয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর খোলা আকাশের নিচে কত মানুষ বসবাস করে এর সঠিক হিসাব কেউ জানে না। তারা এদেশেরই নাগরিক। কিন্তু তাদের স্পষ্ট কোনো হিসাব নেই কারো কাছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের পুনর্বাসন ছাড়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দারিদ্র্যতা, নদীভাঙন, পরিবার ভাঙনসহ বিভিন্ন কারণেই রাজধানী ঢাকায় আসেন একটু আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু কোথাও আশ্রয় না পেয়ে ফুটপাত বা খোলা জায়গাই তাদের শেষ ভরসা।
সরকারি অফিসার ও বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে। তবে এর নির্ধারিত সংখ্যা কত এ বিষয়ে কেউ তথ্য দিতে পারেনি। গত ১১ বছর ধরে শহুরে ছিন্নমূলদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন সাজেদা ফাউন্ডেশন।
তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় তাদের সুবিধাভোগকারী সদস্য রয়েছে ১১ হাজারের কাছাকাছি। ঢাকায় কী পরিমাণ পথবাসী রয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য তাদের কাছে না থাকলেও তাদের ধারণা মতে, এ সংখ্যা ৩০-৩৫ হাজারের ওপরে হতে পারে। ২০০৮ সালের বিবিএস প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীতে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। এ সংখ্যা গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
যাদের একেবারেই ঘরবাড়ি কিছু নেই এমন ব্যক্তিই সাজেদা ফাউন্ডেশনের সদস্য হিসেবে নিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। তাদের এ প্রকল্পটির নাম হচ্ছে ‘আমরাও মানুষ’। এ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে সাতটি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচটি এবং চট্টগ্রামে দুটি। চলতি বছরের আগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী ঢাকার পাঁচটি শাখায় প্রায় ১১ হাজারের কাছাকাছি সুবিধাভোগী রয়েছে। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার শাখায় দুই হাজার ১২৫ জন, মৌচাক শাখায় এক হাজার ৬৩৯ জন, সদরঘাট শাখায় এক হাজার ৪৯১ জন, গ্রিনরোড শাখায় এক হাজার ৮০৫ জন। এছাড়াও মানিকনগর শাখায় বস্তি ও পথবাসী মিলিয়ে চার হাজার ১২ জন সুবিধাভোগী রয়েছে।
এ বিষয়ে সদরঘাট শাখার ম্যানেজার জহিরুল হক আমার সংবাদকে বলেন, আমরা সার্ভের মাধ্যমে সদস্য সিলেক্ট করে থাকি। সদস্য সিলেক্ট হওয়ার পর আমরা সদস্যদের সন্তান থাকলে তাদের ডে-কেয়ার সার্ভিস দিয়ে থাকি। এ প্রকল্পে আমরা দুই বছরের বাচ্চাদের নিয়ে থাকি যারা আমাদের ডে-কেয়ার সেন্টারে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। পরবর্তীতে আমাদের দায়িত্বে স্কুলে ভর্তি করে দেই এবং তাদের পড়ালেখার খরচ সাজেদা ফাউন্ডেশন থেকেই বহন করা হয়। এছাড়াও আমাদের সদস্যরা স্বাস্থ্যসেবা, গোসল, টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা, দিনের বেলায় বিশ্রামের ব্যবস্থা ও রাত্রি যাপন, রান্না করা, বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, সঞ্চয়, লকারের ব্যবস্থাসহ তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য আমাদের অফেরতযোগ্য আমানত দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা তাদের তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেয়ার পর অনুদান দেয়া হয় ব্যবসা করার জন্যে। পরবর্তীতে আমরা তাদের মনিটরিং করি। এই মুহূর্তে আমাদের শাখার আওতায় সুবিধাভোগী সাড়ে পাঁচশ পরিবার রয়েছে। এছাড়া আমরা আরও সাড়ে পাঁচশর মতো পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করেছি। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদেরও এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে।এছাড়াও নারী মৈত্রি ও চিফ নামের দুটি সংগঠনের দুটি করে শেল্টার হোম রয়েছে। যারা পথবাসীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারীদের মধ্যে কেউ কেউ দু-তিন প্রজন্মও কাটিয়ে দিয়েছেন ফুটপাতে। অনেকেরই জন্ম হয়েছে ফুটপাতে, মৃত্যুও সেখানে।
এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকা এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা বলেন, তারা গত ৩০ বছর যাবতই এখানে বসবাস করেন। এক সময় গুলিস্তান পার্কে থাকতেন। এখন রমনা পার্কের পাশে বা সোহরাওয়ার্দীতে থাকেন। গত ৩০ বছরে সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি পাননি। তবে এনজিও সংস্থাগুলো মাঝে মধ্যে সহযোগিতা করে থাকে। সাজিদা ফাউন্ডেশন মূলত এসব মানুষের জীবনমান ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ঢাকার পাঁচটি স্থানে, যেখানে ছিন্নমূল মানুষের দেখা বেশি মিলে সেখানে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছে। সদরঘাটের এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্রে সরেজমিন দেখতে পাই বেশ কয়েকটি শিশু একটি কামরার মধ্যে বসে বসে আর্ট করছে। এটি এই সংস্থাটির একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। দুপুর হওয়ার সাথে সাথে বাচ্চাদের মায়েরা এ কেন্দ্রে আসতে শুরু করে এবং তারা এখানে রান্নার কাজ শেষ করে গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করে আবার বেরিয়ে পড়েছে। এই সংস্থাটির কর্ম এলাকার মধ্যে রয়েছে হাইকোর্ট মাজার চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশ, গুলিস্তান, সদরঘাট, বাদামতলীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। এই আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে যারা থাকেন তাদের দেখা যায় সারি কাঠের বাক্স, তলায় ছোট ছোট চাকা লাগানো। দিনের বেলায় এমন সব চাকা লাগানো বাক্সে চড়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় বহু প্রতিবন্ধীকে। রাতের বেলা সেই বাক্সে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েন তারা। হাইকোর্টের দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাতে গোল হয়ে বসে আরেক দল। সেখান থেকে ভেসে আসছে গাঁজার উৎকট গন্ধ। আশপাশে কি ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে মোটেও সচেতন নন তারা। রাতভর ঢাকার রাস্তায় এরকম বিচিত্র সব মানুষের দেখা মিলে। রাত বাড়ার সাথে সাথে শহর নিস্তব্ধ হতে থাকে, পথ চলতি মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে, শুধু বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ে ফুটপাতে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকা ঘরহীন মানুষদের। কেউবা দিনভর কাজ করে শ্রান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কেউবা মাদকাসক্ত, কেউবা ফুটপাতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন নেশার ঘোরে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই হাজার সুবিধাভোগী রয়েছে বলে আমার সংবাদকে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের ডিজি গাজী মো. নুরুল কবির। তবে রাজধানীতে খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কত সে ব্যাপারে তিনি সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারীদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করার। যেখানে তাদের আঙ্গুলের ছাপ এবং ছবি থাকবে। কারণ তারা ভাসমান, আজকে গুলিস্তান থাকলে কালকে উত্তরা চলে যায়। যে কারণে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এছাড়াও পথশিশুদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় ১৩টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। যার মাধ্যমে ২০১২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১০ হাজার ৭৪০ জন শিশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে শিশু পাঁচ হাজার ৪০৯ ও মেয়ে শিশু পাঁচ হাজার ৩৩১ জন। এর মধ্যে আট হাজার ৫৮৮ জন শিশুকে তাদের পরিবার, আত্মীয় কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে পুনঃএকীকরণ বা পুনর্বাসন করা হয়েছে। শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসমূহের প্রতিটিতে ১০০ ছেলে ও ১০০ মেয়ে শিশুর জন্য পৃথক ভবনে আবাসন সুবিধা রয়েছে। কেন্দ্রের প্রতিটি শিশুকে সকাল ও বিকালের নাস্তাসহ দুই বেলা খাবার পরিবেশন করা হয়। জাতীয় দিবস, ধর্মীয় উৎসবসহ বিশেষ দিবসে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। নিবাসী শিশুদের বছরে চার সেট পোশাক, দুই সেট উৎসব পোশাক এবং শীতবস্ত্র প্রদান করা হয়। এছাড়া স্কুলগামী শিশুদের জন্য স্কুলের ড্রেস কোড অনুযায়ী পোশাক সরবরাহ করা হয়।
কেন্দ্রগুলো দিবা ও রাত্রিকালীন সার্বক্ষণিক আশ্রয়সেবা প্রদান করে থাকে। ১৪ বছর ঊর্ধ্ব শিশুদের আগ্রহ ও সক্ষমতার ভিত্তিতে স্থানীয় চাহিদা নিরূপণপূর্বক কম্পিউটার (অফিস ব্যবস্থাপনা), মোবাইল সার্ভিসিং, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী মেরামত, অটোমোবাইল, বিউটিফিকেশন, টেইলারিং, ব্লক-বাটিক, সূচিশিল্প, আর্ট (ব্যানার বা সাইনবোর্ড), পারিবারিক সবজি চাষ ইত্যাদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের ১০ হাজার টাকা করে ঋণ প্রদান করে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি Alokito Sakal'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyalokitosakal@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
Alokito Sakal'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।